মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের জন্ম ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তদানিন্তন যশোর জেলার (বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলা) মহেশপুর উপজেলার খর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে। তার পিতার নাম আক্কাস আলী মন্ডল এবং মায়ের নাম মোসাম্মাৎ কায়মুন্নেসা। শৈশবে তিনি খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে স্থানীয় নাইট স্কুলে সামান্য লেখাপড়া করেন।
১৯৭০ সালে হামিদুর যোগ দেন সেনাবাহিনীতে সিপাহী পদে৷ তার প্রথম ও শেষ ইউনিট ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট৷ সেনাবাহিনীতে ভর্তির পরই প্রশিক্ষণের জন্য তাকে পাঠানো হলো চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে৷ ২৫ মার্চের রাতে চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ওখানকার আরও কয়েকটি ইউনিটের সমন্বয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়৷
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে চাকরিস্থল থেকে নিজ গ্রামে চলে আসেন। বাড়ীতে একদিন থেকে পরদিনই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য চলে যান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার ধলই চা বাগানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ধলই বর্ডার আউটপোস্টে। তিনি ৪নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে হামিদুর রহমান ১ম ইস্টবেঙ্গলের সি কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন। ভোর চারটায় মুক্তিবাহিনী লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌছে অবস্থান নেয়। সামনে দু প্লাটুন ও পেছনে এক প্লাটুন সৈন্য অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে শত্রু অভিমুখে। শত্রু অবস্থানের কাছাকাছি এলে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। মুক্তিবাহিনী সীমান্ত ফাঁড়ির খুব কাছে পৌছে গেলেও ফাঁড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত হতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিবর্ষণের জন্য আর অগ্রসর হতে পারছিলো না। অক্টোবরের ২৮ তারিখে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান বাহিনীর ৩০এ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্ব দেয়া হয় হামিদুর রহমানকে। তিনি পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে বুকে হেঁটে গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। দুটি গ্রেনেড সফলভাবে মেশিনগান পোস্টে আঘাত হানে, কিন্তু তার পরপরই হামিদুর রহমান গুলিবিদ্ধ হন। সে অবস্থাতেই তিনি মেশিনগান পোস্টে গিয়ে সেখানকার দুই জন পাকিস্তানী সৈন্যের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করেন। এভাবে আক্রণের মাধ্যমে হামিদুর রহমান এক সময় মেশিনগান পোস্টকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম হন। এই সুযোগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল উদ্যমে এগিয়ে যান, এবং শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে সীমানা ফাঁড়িটি দখল করতে সমর্থ হন। কিন্তু হামিদুর রহমান বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করতে পারেননি, ফাঁড়ি দখলের পরে মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হামিদুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে। হামিদুর রহমানের মৃতদেহ সীমান্তের অল্প দূরে ভারতীয় ভূখন্ডে ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামের স্থানীয় এক পরিবারের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। নিচু স্থানে অবস্থিত কবরটি এক সময় পানির তলায় তলিয়ে যায়। ২০০৭ সালের ২৭শে অক্টোবর বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুযায়ী ২০০৭ সালের ১০ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করে, এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে কুমিল্লার বিবিরহাট সীমান্ত দিয়ে শহীদের দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১১ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয় সিপাহী হামিদুর রহমানকে। এছাড়া তার নিজের গ্রাম 'খোর্দ খালিশপুর'-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় হামিদনগর৷ এই গ্রামে তার নামে রয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ ঝিনাইদহ সদরে রয়েছে একটি স্টেডিয়াম।একটি ফেরিও তার নামে রাখা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে খালিশপুর বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি কলেজ ৷ স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর এই শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে তার গ্রামে লাইব্রেরি ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৷ ১২ জুন ২০০৭ সালে এই কলেজ প্রাঙ্গণে ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে শুরু হয় এই নির্মাণ কাজ৷
২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (টিএসসিসি) নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের নামে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান কেন্দ্রীয় মিলনায়তন নামকরণ করা হয়েছে।
মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাবিবুর রহমান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার ছিলেন। শৈশব থেকেই দুঃসাহসী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারেননি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর উচ্চ বিদ্যালয়ে দু-এক বছর অধ্যয়ন করেন।
মোস্তফা কামালের ছেলেবেলা তার পিতার কর্মস্থল কুমিল্লা সেনানিবাসে কেটেছে। বিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার চেয়ে সেনানিবাসে সেনাদের কুচকাওয়াজ, মার্চপাস্ট ইত্যাদি ভাল লাগতো। ক্রমেই তিনি সেনাবাহিনীর একজন সদস্য হবার স্বপ্ন দেখতে থাকেন এবং স্থির করেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিবেন। ২০ বছর বয়সে হঠাৎ করেই মোস্তফা কামাল বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশে হয়ে যান। পরে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের চতুর্থ ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি চূড়ান্ত হবার পরে তার বাবা-মা সন্ধান পান।
১৯৬৭-র ১৬ ডিসেম্বর বাড়ী থেকে পালিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। ১৯৭১-এর প্রথম দিকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। তখন সারাদেশে যুদ্ধের বিভৎসতা ছড়িয়ে পড়ছিলো। সেনানিবাসগুলোতে অবস্থা উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে এন্ডারসন খালের পাঁড়ে। আখাউড়ায় অবস্থিত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিণ দিক থেকে নিরাপত্তার জন্য দরুইন গ্রামের দুই নম্বর প্লাটুনকে নির্দেশ দেয়। সিপাহী মোস্তফা কামাল ছিলেন দুই নম্বর প্লাটুনে। কর্মতৎপরতার জন্য যুদ্ধের সময় মৌখিকভাবে তাকে ল্যান্স নায়েকের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়।
১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে এগুতে থাকে। ১৮ই এপ্রিল পরদিন ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দরুইন গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর মর্টার ও আর্টিলারীর গোলাবর্ষণ শুরু করলে মেজর শাফায়াত জামিল ১১ নম্বর প্লাটুনকে দরুইন গ্রামে আগের প্লাটুনের সাথে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। ১১ নম্বর প্লাটুন নিয়ে হাবিলদার মুনির দরুইনে পৌছেন। সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল তার নিকট থেকে গুলি নিয়ে নিজ পরিখায় অবস্থান গ্রহণ করেন। বেলা ১১ টার দিকে শুরু হয় শত্রুর গোলাবর্ষণ। সেই সময়ে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। সাড়ে ১১টার দিকে মোগরা বাজার ও গঙ্গা সাগরের শত্রু অবস্থান থেকে গুলি বর্ষিত হয়। ১২ টার দিকে আসে পশ্চিম দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ। প্রতিরক্ষার সৈন্যরা আক্রমণের তীব্রতায় বিহ্বল হয়ে পড়ে। কয়েক জন শহীদ হন। মোস্তফা কামাল মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন। তার পূর্ব দিকের সৈন্যরা পেছনে সরে নতুন অবস্থানে সরে যেতে থাকে এবং মোস্তফাকে যাবার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু তাদের সবাইকে নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগের জন্য মোস্তফা পূর্ণোদ্যমে এল.এম.জি থেকে গুলি চালাতে থাকেন। তার ৭০ গজের মধ্যে শত্রুপক্ষ চলে এলেও তিনি থামেননি। এতে করে শত্রু রা তার সঙ্গীদের পিছু ধাওয়া করতে সাহস পায়নি। এক সময় গুলি শেষ হয়ে গেলে, শত্রুর আঘাতে তিনিও লুটিয়ে পড়েন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয় মোহাম্মদ মোস্তফা কামালকে। এছাড়া তার নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজ প্রাঙ্গণের একটি কোণে ভোলা জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লাইব্রেরি ও জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। এছাড়া মোস্তফা কামালের নামানুসারে গ্রামের নাম মৌটুপীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে কামালনগর৷
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে তার শাহাদাত স্থানের পাশেই এ গ্রামের জনগণ তাকে সমাহিত করেন। সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
মোহাম্মদ রুহুল আমিন
জন্ম ১৯৩৫ বাঘপাঁচড়া গ্রাম, নোয়াখালী
মৃত্যু ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ (বয়স ৩৫–৩৬)
জাতীয়তা বাংলাদেশি
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত), পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে) বাংলাদেশ
পেশা ইআরএ-১ (ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার-১)
পরিচিতির কারণ বীর শ্রেষ্ঠ
মোহাম্মদ রুহুল আমিন (১৯৩৫ - ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাদের অন্যতম।
মোহাম্মদ রুহুল আমিনের সমাধি
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
মোহাম্মদ রুহুল আমিন ১৯৩৫ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার বাঘপাঁচড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আজহার পাটোয়ারী এবং মায়ের নাম জোলেখা খাতুন। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। তারা ছিলেন ছয় ভাইবোন। তিনি বাঘচাপড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে আমিষাপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখান থেকে এসএসসি পাশ করে ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন।
কর্মজীবন
মোহাম্মদ রুহুল আমিন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য তিনি যান করাচির নিকটবর্তী আরব সাগরে মধ্যে অবস্থিত মানোরা দ্বীপে পাকিস্তানি নৌঘাঁটি (পি.এন.এস) বাহাদুরে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর সেখান থেকে পি.এন.এস. কারসাজে যোগদান করেন। পরবর্তীতে পি.এন.এস বাবর, পি.এন.এস খাইবার এবং পি.এন.এস তুঘরিলে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালে পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ১৯৬৫ সালে মেকানিসিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন। পি.এন.এস. কারসাজে কোর্স সমাপ্ত করার পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম পি.এন.এস. বখতিয়ার নৌঘাঁটিতে বদলি হয়ে যান। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ঘাঁটি থেকে পালিয়ে যান। বাড়িতে গিয়ে ছাত্র, যুবক ও সামরিক আধাসামরিক বাহিনীর লোকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। এর কিছুদিন পর ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা সেক্টর প্রধান কোয়ার্টারে যান এবং সেখানে মেজর শফিউল্লাহর অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে বিভিন্ন স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
১৯৭১ সালের মার্চে রুহুল আমিন চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন৷ একদিন সবার অলক্ষ্যে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে পড়েন নৌঘাঁটি থেকে৷ পালিয়ে সীমান্ত পার হয়ে তিনি চলে যান ত্রিপুরা৷ যোগ দেন ২ নং সেক্টরে৷ মেজর শফিউল্লাহের নেতৃত্বে ২ নং সেক্টরে তিনি সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং স্থলযুদ্ধের বিভিন্ন অভিযানে যোগ দেন৷ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়৷ এ উদ্দেশ্যে নৌবাহিনীর সদস্যদের যাঁরা বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করছিলেন তাদেরকে সেপ্টেম্বর মাসে একত্রিত করা হয় আগরতলায় এবং গঠন করা হয় ১০ নং সেক্টর৷ ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন নৌবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আগরতলায় একত্রিত হয়ে কলকাতায় আসেন এবং যোগ দেন ১০ নং নৌ সেক্টরে৷ পরবর্তীকালে অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নিজস্ব একটি নৌবাহিনী তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন মণীন্দ্রনাথ সামন্তের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টর থেকে নৌবাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করার ব্যবস্থা করা হয়। আর এ উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠিত হলে কলকাতায় চলে আসেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী কে কলকাতা বন্দরে গার্ডেনরিচ ডক ইয়ার্ডে দুইটি গানবোট উপহার দেয়।[৪] সেখানে প্রতিটি বোটে কানাডীয় ধরনের ২টি বাফার গান লাগিয়ে এবং ব্রিটিশ ধরনের ৫০০ পাউন্ড ওজনের ৪টি মার্কমাইন বহনের উপযোগী করে গানবোটে রূপান্তর করা হয়। গানবোটগুলোর নামকরণ করা হয় 'পদ্মা' ও 'পলাশ'। রুহুল আমিন পলাশের প্রধান ইঞ্জিনরুমে আর্টিফিসার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে যশোর সেনানিবাসের পতন ঘটে। পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত খুলনাস্থ নৌঘাট দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারতীয় গানবোট পাভেলের সাথে যুক্ত হয়ে ১০ ডিসেম্বর মংলা বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনা ও নৌবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। 'পলাশ' ও 'পদ্মা' মংলা বন্দর হয়ে খুলনার দিকে রওয়ানা দেয়। গানবোট 'পাভেল' সামনে আর পেছনে 'পলাশ' ও 'পদ্মা'।
যেভাবে শহীদ হলেন
৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলের পর 'পদ্মা', 'পলাশ' এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি গানবোট 'পাভেল' খুলনার মংলা বন্দরে পাকিস্তানি নৌঘাঁটি পি.এন.এস. তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে এলে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৩টি জঙ্গিবিমান জাহাজগুলোর দিকে ছুটে আসে। পাকিস্তানী বিমান ভেবে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু অভিযানের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন মনেন্দ্রনাথ ভারতীয় বিমান মনে করে গুলিবর্ষণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। এর কিছুক্ষণ পরে বিমানগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে নিচে নেমে আসে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জাহাজগুলোর উপর আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু ভারতীয় জাহাজটি সম্পূর্ন অক্ষত থেকে যায়, কারণ বিমানগুলো সেটিকে লক্ষ করে হামলাই করেনি। প্রথম গোলা এসে পড়ে 'পদ্মা'য় এবং পরবর্তীতে 'পলাশে'। গোলা সরাসরি 'পদ্মা'র ইঞ্জিন রুমে আঘাত করে ইঞ্জিন বিধ্বস্ত করে। হতাহত হয় অনেক নাবিক। 'পদ্মা'-র পরিণতিতে পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন এই আদেশে ক্ষিপ্ত হন। তিনি উপস্থিত সবাইকে যুদ্ধ বন্ধ না করার আহ্বান করেন। কামানের ক্রুদের বিমানের দিকে গুলি ছুঁড়তে বলে ইঞ্জিন রুমে ফিরে আসেন। কিন্তু অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে বিমানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। বিমানগুলো উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করে পলাশের ইঞ্জিনরুম ধ্বংস করে দেয়। আহত হন তিনি। কিন্তু অসীম সাহসী রুহুল আমিন তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যান 'পলাশ'কে বাঁচানোর। তবে ইঞ্জিন বিকল হয়ে আগুন ধরে যায় এবং গোলার আঘাতে রুহুল আমিনের ডান হাতটি সম্পূর্ণ উড়ে যায়। অবশেষে পলাশের ধ্বংশাবশেষ পিছে ফেলেই আহত রুহুল আমিন ঝাঁপিয়ে পড়েন রূপসা নদীতে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এ যোদ্ধা একসময় পাড়েও এসে পৌঁছান। কিন্তু ততক্ষণে সেখানে রাজাকারের দল অপেক্ষা করছে তার জন্য। আহত এই বীর সন্তান রাজাকারদের হাতে শহীদ হন। তার মৃতদেহ বেশকিছুদিন সেখানে পড়ে ছিলো অযত্নে, অবহেলায়। পরবর্তীতে স্থানীয় জনসাধারণ বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীর পাড়ে তাকে দাফন করে এবং সেখান একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ সম্মান
১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকারি গেজেট নোটিফিকেশন অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাতজন বীর সন্তানকে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। রুহুল আমিন সেই সাতজনের অন্যতম।
পুরস্কার ও সম্মাননা
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের নামে রো রো ফেরির নামকরণ করা হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিনের জন্মস্থান নোয়াখালীর বাগপাদুরা গ্রামের নাম পরিবর্তন করে এখন রাখা হয়েছে তার নামে আমিননগর৷ বাড়ির সম্মুখে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের দেয়া ২০ শতাংশ জমিতেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নোয়াখালী জেলা পরিষদ ৬২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছে রুহুল আমিন স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার৷ রুহুল আমিনের নামে চট্টগ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে।তার নামে অনেক পুরস্কারও প্রচলিত রয়েছে।
মতিউর রহমান (বীরশ্রেষ্ঠ)
জন্ম ২৯ অক্টোবর ১৯৪১ ঢাকা, বঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ)
মৃত্যু ২০ আগস্ট ১৯৭১ (বয়স ২৯) থাট্টা, পশ্চিম পাকিস্তান
সার্ভিস/শাখা পাকিস্তান বিমান বাহিনী
কার্যকাল ১৯৬৩–৭১ (আমৃত্যু)
পদমর্যাদা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট
ইউনিট নম্বর. ২ স্কোয়াড্রন
যুদ্ধ/সংগ্রাম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ১৯৬৫, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ
দাম্পত্য সঙ্গী মিলি রহমান
বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (২৯ অক্টোবর ১৯৪১ - ২০ আগস্ট ১৯৭১) বাংলাদেশের একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাদের অন্যতম।
জন্ম এবং শিক্ষা জীবন
মতিউর রহমান ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯, আগা সাদেক রোডের "মোবারক লজ"-এ জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে। যা এখন মতিনগর নামে পরিচিত। ৯ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ। তার বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ডিস্টিংকশনসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
১৯৬৩ সালে নতুন পাইলট অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তগণ (মতিউর রহমান, সামনের সারিতে ডান থেকে দ্বিতীয়)
কর্মজীবন
মতিউর রহমান ১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে রিসালপুর পি,এ,এফ কলেজ থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। কমিশন প্রাপ্ত হবার পর তিনি করাচির মৌরিপুর (বর্তমান মাসরুর) এয়ার বেজ এর ২ নম্বর স্কোয়ার্ডন এ জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি টি-৩৩ জেট বিমানের উপর কনভার্সন কোর্স সম্পন্ন করেন এবং ৭৫.৬৬% নম্বর পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি এফ-৮৬ স্যাবর জেট এর উপরেও কনভার্সন কোর্স করেন এবং ৮১% নম্বর পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। বৈমানিক কনভার্সন কোর্স এ ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে তাকে পেশোয়ারে (১৯ নং স্কোয়ার্ডন) এ পোস্টিং দেয়া হয়।
১৯৬৫ তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার অবস্থায় কর্মরত ছিলেন। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই তারিখে একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটা হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে দক্ষতার সাথে প্যারাসুট যোগে মাটিতে অবতরণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দু'বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসাবে কাজ করার পর ১৯৭০ এ বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
১৯৭১ সালের শুরুতে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর রহমান সপরিবারে ঢাকায় দুই মাসের ছুটিতে আসেন। ২৫ মার্চের কালরাতে তিনি ছিলেন নরসিংদীর রায়পুরার রামনগর গ্রামে৷ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সাথে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন৷ যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন ৷ তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং বিরাট মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ বাহিনী। পাক-সৈন্যরা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টে ই,পি,আর-এর সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এফ-৮৬ স্যাবর জেট থেকে তাদের ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে ৷ মতিউর রহমান পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন৷ তাই ঘাঁটি পরিবর্তন করেন এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তার বাহিনী৷
এরপর ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকা আসেনও ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান ৷ কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে জঙ্গি বিমান দখল এবং সেটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাকে তখন বিমানের সেফটি অফিসারের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। তিনি বিমান দখলের জন্য ২১ বছর বয়সী রাশেদ মিনহা্জ নামে একজন শিক্ষানবীশ পাইলটের উড্ডয়নের দিন (২০ই আগস্ট,১৯৭১) টার্গেট করেন। তার পরিকল্পনা ছিলো মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পেয়ে গেলে তিনি তার কাছ থেকে বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নেবেন। পরিকল্পনা অনুসারে অফিসে এসে শিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে৷ সামনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩ । পাইলট রাশেদ মিনহাজ বিমানটি নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত একক উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কন্ট্রোল টাওয়ার ক্লিয়ারেন্সের পর মিনহাজ বিমানটি নিয়ে রানওয়েতে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিলে মতিউর রহমান সেফটি অফিসারের ক্ষমতাবলে বিমানটি থামাতে বলেন। মিনহাজ বিমানটি থামান এবং ক্যানোপি ( জঙ্গি বিমানের বৈমানিকদের বসার স্থানের উপরের স্বচ্ছ আবরন) খুলে বিমান থামানোর কারণ জানতে চান। এসময় মতিউর রহমান বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং রাশেদ মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে ফেলেন। জ্ঞান হারানোর আগে রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোল রুমে জানাতে সক্ষম হন তিনিসহ বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে। বিমানটি ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার মিনহাজের বার্তা শুনতে পায় এবং রাডারে বিমানের অবস্থান বুঝে অপর চারটি জঙ্গি বিমান মতিউরের বিমানকে ধাওয়া করে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও মতিউর রহমান বিমানটি নির্ধারিত সীমার নিচে চালিয়ে রাডার কে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আসার চেষ্টা করেন।
মৃত্যু
প্রায় ভারতের সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া অবস্থায় রাশেদ মিনহাজ জ্ঞান ফিরে পান এবং বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করেন। রাশেদ চাইছিলেন, মতিউর রহমানের বিমান ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা সফল হওয়ার চেয়ে বিমানটি বিধ্বস্ত করা ভালো । এ সময় রাশেদের সাথে মতিউরের ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রাশেদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে ছিটকে পড়েন। বিমানটি কম উচ্চতায় উড্ডয়ন করার ফলে একসময় রাশেদ সহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। মতিউর রহমানের সাথে প্যারাসুট না থাকায় তিনি নিহত হন। তার মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়।
২০ই আগস্ট,১৯৭১ এ মতিউর রহমান এবং রাশেদ মিনহাজ স্ব স্ব দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ সরকার মতিউর রহমানকে তার সাহসী ভূমিকার জন্য বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে এবং রাশেদ মিনহাজকে পাকিস্তান সরকার সম্মানসূচক খেতাব দান করে। প্রসঙ্গতঃ একই ঘটনায় দুই বিপরীত ভূমিকার জন্য দুইজনকে তাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক খেতাব প্রদানের এমন ঘটনা বিরল।
সমাধি স্থানান্তর
শাহাদতের ৩৫ বছর পর ২৪শে জুন ২০০৬ মতিউরের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে দেশে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধজীবী কবর স্থানে পুনঃসমাহিত করা হয়।
পাকিস্তান সরকার মতিউর রহমানের মৃতদেহ করাচির মাসরুর ঘাটির চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে সমাহিত করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ার পর, ২০০৬ সালের ২৪ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান হতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫শে জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়।
টিভির পর্দায় মতিউর
মতিউর রহমানকে নিয়ে অগ্নিবলাকা নামের একটি ডকুড্রামা নির্মাণ করা হয় ২০০২ সালে যেখানে রিয়াজ মতিউর রহমানের চরিত্রে এবং তারিন ওনার স্ত্রী মিলির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া তার জীবনী নিয়ে ২০০৭ সালে অস্তিত্বে আমার দেশ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়।
সম্মাননা
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যশোর বিমান ঘাটি তারঁ নামে নামকরণ করা হয়েছে। বিমান বাহিনী তার নামে একটি ট্রফি চালু করেছে। বিমান প্রশিক্ষনে সেরা কৃতিত্ব প্রদর্শনকারীকে এটি প্রদান করা হয়।
মুন্সি আব্দুর রউফ
জন্ম ১ মে, ১৯৪৩
সালামতপুর, ফরিদপুর
মৃত্যু ২০ এপ্রিল, ১৯৭১
বুড়িঘাট, মহালছড়ি
জাতীয়তা বাংলাদেশি
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত), পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে), বাংলাদেশ
পরিচিতির কারণ বীর শ্রেষ্ঠ
মুন্সি আব্দুর রউফ (১ মে ১৯৪৩ - ২০ এপ্রিল ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাঁদের অন্যতম তিনি ১৯৬৩ সালের ৮ মে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে যোগদান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি নিয়মিত পদাতিক সৈন্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুড়িঘাট গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল তিনি মর্টার শেলের আঘাতে শহীদ হন। তাঁকে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাটে একটি টিলার ওপর সমাহিত করা হয়।
জন্ম ও শৈশব
মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ১ মে[৩] ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার (পূর্বে বোয়ালমারী উপজেলার অন্তর্গত) সালামতপুরে (বর্তমান নাম রউফ নগর)[৪] গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মুন্সি মেহেদি হাসান ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাতা মুকিদুন্নেসা। তাঁর ডাকনাম ছিলো রব। তাঁর দুই বোনের নাম ছিল জোহরা এবং হাজেরা। তিনি সাহসী ও মেধাবী ছিলেন, কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তেমন ঝোঁক ছিলো না। শৈশবে তাঁর বাবার কাছে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
১৯৫৫ সালে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেন নি। সংসারের হাল ধরতে অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ১৯৬৩ সালের ৮ মে আব্দুর রউফ যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে। সেসময় তাঁকে ৩ বছর বেশি বয়স দেখাতে হয়েছিলো চাকরিটা পাওয়ার জন্য। চুয়াডাঙ্গার ইপিআর ক্যাম্প থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ করে আব্দুর রউফ উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে যান। ছয় মাস পরে তাঁকে কুমিল্লায় নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে ১১ নম্বর উইং-এ তিনি কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুন্সি আব্দুর রউফ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে তিনি চট্টগ্রামে ১১ উইং-এ চাকুরিরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ল্যান্স নায়েক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগানার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই জলপথ দিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর চলাচল প্রতিরোধের দায়িত্ব পড়ে তাঁর কোম্পানির উপর। কোম্পানিটি বুড়িঘাট এলাকার চেঙ্গিখালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে গড়ে তোলে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি।
২০ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল নিয়ে বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটিকে বিধ্বস্ত করতে সাতটি স্পিডবোট এবং দুইটি লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। এটি ছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের (এসএসজি) কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। স্পিডবোট থেকে মেশিনগানের গুলি এবং আর লঞ্চ দুইটি থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল নিক্ষেপ করছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিলো রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা।
যেভাবে শহীদ হন
অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পরিখায় অবস্থান নিয়ে নেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাগুলির তীব্রতায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে আব্দুর রউফ বুঝতে পারেন, এভাবে চলতে থাকলে ঘাঁটির সকলকেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মৃত্যু বরণ করতে হবে। তিনি তখন কৌশলগত কারণে পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত সৈন্যদের জানানো হলে সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করে। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী তখন খুব কাছে চলে আসে। ফলে সকলে একযোগে পিছু হটতে থাকলে একসাথে সকলকেই মৃত্যুবরণ করতে হতে পারে ভেবে আব্দুর রউফ পিছু হটেন নি। সহযোদ্ধাদের পিছু হটার সুযোগ করে দিতে নিজে পরিখায় দাঁড়িয়ে অনবরত গুলি করতে থাকেন পাকিস্তানি স্পিডবোটগুলোকে লক্ষ্য করে। পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে একা কৌশলে লড়ছিলেন তিনি। তিনি তাদের সাতটি স্পিডবোট একে একে ডুবিয়ে দিলে তারা তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। লঞ্চ দুটো পিছু হটে রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এরপর লঞ্চ থেকে মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। মর্টারের গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রউফের একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তবু তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান। হঠাৎ একটি মর্টারের গোলা তাঁর বাঙ্কারে এসে পড়ে এবং তিনি শহীদ হন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর আগে সহযোগী যোদ্ধারা সবাই নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতে পেরেছিলো। সেদিন আব্দুর রউফের আত্মত্যাগে তাঁর কোম্পানির প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা পায়।

রাঙামাটির নানিয়ার চরে তাঁর কবর
সমাধিস্থল
শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধি পার্বত্য জেলা রাঙামাটির নানিয়ার চরে অবস্থিত। তাঁর অপরিসীম বীরত্ব, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্ব্বোচ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলাদেশ রাইফেলস ১৯৭৩ সালে সিপাহি মুন্সি আব্দুর রউফকে অনারারি ল্যান্স নায়েক পদে মরণোত্তর পদোন্নতি প্রদান করে।
সম্মাননা
২০১৪-এ পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস কলেজের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ তাঁর স্মৃতিতে শালবাগান, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক, সাপছড়ির মধ্যবর্তী স্থানে ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন (ECB-16) একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে। মানিকছড়ি, মুসলিম পাড়া, মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি এর একটি উচ্চ বিদ্যালয় তার নামে রাখা হয়েছে। সিলেটের একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম তার নামে রাখা হয়েছে। ফরিদপুর জেলার একটি কলেজ তার নামে রাখা হয়েছে, যেটি সরকারিকরণ করা হয়েছে।
শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধিস্তম্ভ, বুড়িঘাট, নানিয়ারচর, রাঙামাটি - উত্তর দিক থেকে দৃশ্য
শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধিস্তম্ভ, বুড়িঘাট, নানিয়ারচর, রাঙামাটি - উত্তর দিক থেকে দ্বীপের দৃশ্য
নূর মোহাম্মদ শেখ
জন্ম ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬
মহিষখোলা, নড়াইল, ব্রিটিশ ভারত
মৃত্যু ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ (বয়স ৩৫), গোয়ালহাটি, যশোর
জাতীয়তা বাংলাদেশী
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত), পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে), বাংলাদেশ
পেশা সৈনিক
পরিচিতির কারণ বীর শ্রেষ্ঠ
দাম্পত্য সঙ্গী বেগম ফজিলাতুন্নেছা (তোতাল বিবি)
নূর মোহাম্মদ শেখ (ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯৩৬ - সেপ্টেম্বর ৫, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তিনি তাদের অন্যতম।
জীবন ও শিক্ষা
১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল জেলার মহিষখোলা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে নূর মোহাম্মদ শেখ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ আমানত শেখ, মাতা জেন্নাতুন্নেসা। অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারান ফলে শৈশবেই ডানপিটে হয়ে পড়েন। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সপ্তম শ্রেণীর পর আর পড়াশোনা করেননি। কৈশোরে তিনি নাটক থিয়েটার ইত্যাদি খুব পছন্দ করতেন। ১৯৫২ সালে নিজ গ্রামেরই সম্পন্ন কৃষক ঘরের মেয়ে তোতাল বিবিকে বিয়ে করেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর এবং স্ত্রী তোতাল বিবির বয়স মাত্র ১২ বছর। তিনি দুই সন্তানের বাবা ছিলেন। ১৯৫৪ সালের শেষ দিকে তার প্রথম সন্তান হাসিনা খাতুন,এবং ১৯৬৪ সালের ১৫ নভেম্বর তার দ্বিতীয় সন্তান শেখ মো. গোলাম মোস্তফা জন্মগ্রহণ করেন।
কর্মজীবন
যুবক নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৫৯-এর ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর-এ যোগদান করেন।.[৪] দীর্ঘদিন দিনাজপুর সীমান্তে চাকরি করে ১৯৭০ সালের ১০ জুলাই নূর মোহাম্মদকে দিনাজপুর থেকে যশোর সেক্টরে বদলি করা হয়। এরপর তিনি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধ চলাকালীন যশোরের শার্শা থানার কাশিপুর সীমান্তের বয়রা অঞ্চলে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা'র নেতৃত্বে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
যেভাবে শহীদ হলেন
১৯৭১-এর ৫ সেপ্টেম্বর সুতিপুরে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যূহের সামনে যশোর জেলার গোয়ালহাটি গ্রামে নূর মোহাম্মদকে অধিনায়ক করে পাঁচ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোল পাঠানো হয়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পেট্রোলটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা থেকে পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হয়। তবু পেট্রোলটি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। এক সময়ে সিপাহী নান্নু মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে নূর মোহাম্মদ নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নেন এবং হাতের এল.এম.জি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করলে শত্রুপক্ষ পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। হঠাৎ করেই শত্রুর মর্টারের একটি গোলা এসে লাগে তার ডান কাঁধে যাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন।
শত্রুর গোলায় ধরাশয়ী হওয়া মাত্র আহত নান্নু মিয়াকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন নূর মোহাম্মদ শেখ। হাতের এল.এম.জি সিপাহী মোস্তফাকে দিয়ে নান্নু মিয়াকে নিয়ে যেতে বললেন এবং মোস্তফার রাইফেল চেয়ে নিলেন যতক্ষণ না ওঁরা নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে সক্ষম হন ততক্ষণ ঐ রাইফেল চালিয়ে দিয়ে শত্রুসৈন্যের অগ্রসারতা ঠেকিয়ে রাখবেন এবং শত্রুর মনোযোগ তার দিকেই কেন্দ্রীভুত করে রাখবেন এই মানসে। অন্য সঙ্গীরা অনুরোধ করলেন তাদের সাথে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু তাকে বহন করে নিয়ে যেতে গেলে সবাই মারা পড়বে এই আশঙ্কায় তিনি রণক্ষেত্র ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। বাকিদের অধিনায়োকোচিত আদেশ দিলেন তাকে রেখে চলে যেতে।
শেষ পর্যন্ত তার আদেশ অনুসরণ করে তাকে রেখেই নিরাপদে সরে যেতে পারলেন সহযোদ্ধারা। এদিকে সমানে গুলি ছুড়তে লাগলেন রক্তাক্ত নূর মোহাম্মদ। একদিকে পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনী, সঙ্গে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, অন্যদিকে মাত্র অর্ধমৃত সৈনিক (ই.পি.আর.) যাঁর সম্বল একটি রাইফেল ও সীমিত গুলি। এই অসম অবিশ্বাস্য যুদ্ধে তিনি শত্রুপক্ষের এমন ক্ষতিসাধন করেন যে তারা এই মৃত্যুপথযাত্রী বীর যোদ্ধাকে বেয়নেট চার্জ করে চোখ দুটো উপড়ে ফেলে এবং মস্তক বিদীর্ন করে ঘিলু ছড়িয়ে ফেলে। পরে প্রতিরক্ষার সৈনিকরা এসে পাশের একটি ঝাড় থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে।
সমাধি
অন্যান্য শহীদদের সাথে নূর মোহাম্মদ শেখের সমাধি
এই বীরসেনানীকে পরবর্তীতে যশোরের কাশিপুর গ্রামে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছেই সমাহিত করা হয়।