রাজাকার (পাকিস্তান)
রাজাকার বা রেজাকার হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত একটি আধাসামরিক বাহিনী। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী বাঙালি এবং উর্দুভাষী অবাঙালি অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্যে লড়াইরত মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়।
রাজাকার শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে আগত, এর অর্থ স্বেচ্ছাসেবী।[১][২] ১৯৪০-এর দশকে ভারতের হায়দ্রাবাদের নিজাম ওসমান আলী খানের শাসনামলে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন কাসেম রিজভী, যে বাহিনীর নাম দেয়া হয়েছিল রাজাকার৷ হায়দ্রাবাদের সেই সশস্ত্র বাহিনীর অনুকরণেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার।[৩][৪]
পটভূমি
১৯৭১ সালে যুদ্ধরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে রাজাকার দল গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানকল্পে মে মাসে খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন পাকিস্তানপন্থী কর্মী নিয়ে হায়দ্রাবাদের ‘রাজাকার’-এর অনুকরণে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়।[৫] মে মাসে ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান মো. ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়৷ পরবর্তীকালে দেশের অন্যান্য অংশেও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়।
প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন৷ ১৯৭১ সালের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অধ্যাদেশ জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন৷ এর নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তানপন্থী স্থানীয় নেতাদের হাতে৷ পরে ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত অধ্যাদেশে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনী সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
প্রশিক্ষণ
রাজাকার বাহিনীর প্রাথমিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন। ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় রাজাকারবাহিনীর প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং সমাপ্ত হয়। পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক অধিনায়ক জেনারেল এ.এ.কে নিয়াজী ১৯৭১ সালের ২৭শে নভেম্বর সাভারে রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদায় উন্নীত হয়।[২]
বিলুপ্তি
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে রাজাকার বাহিনীর স্বাভাবিক বিলুপ্তি ঘটে।
কয়েকজন অভিযুক্ত রাজাকার
গোলাম আযম [৬],[৭]
আব্বাস আলী খান, জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর [৮]
মতিউর রহমান নিজামী [৬],[৭]
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ- ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরীর প্রধান। [৯]
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান- জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল [৮]
দেলোয়ার হোসেন সাঈদী- জামাতে ইসলামীর মজলিসের শুরার সদস্য [৮]
আবদুল কাদির মোল্লা, জামাতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক [৮]
ফজলুল কাদের চৌধুরী [৭]
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী [৬]
মীর কাসেম আলী [৬]
আল বদর
আল বদর ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা দানকারী নিন্দিত আধা-সামরিক বাহিনী।[১] যার সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে অখণ্ড রাখার উদ্দেশ্যে জনমত গঠন করার জন্য। পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল। ইসলামিক ইতিহাসের বদর যুদ্ধকে আদর্শ করে এই বাহিনী গঠিত হলেও এদের মূলকাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া । মে মাসে রাজাকার বাহিনী গঠনের আগেই এপ্রিল মাসে গঠিত হয় আল বদর বাহিনী। রাজাকার বাহিনী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে তারা একতা ও অখণ্ডতায় বিশ্বাস করত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর পতনের পর এই বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটে।
আল বদর বাহিনী
আলবদর
অংশগ্রহণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
সক্রিয় ২২ এপ্রিল - ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
মতবাদ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ,
পাকিস্তানের অখন্ডতা,
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা
নেতৃবৃন্দ মুহম্মদ আশরাফ হোসাইন,
মতিউর রহমান নিজামী
অপারেশনের এলাকা বাংলাদেশ
আকার ৩১৩ (১৯৭১)
মিত্রপক্ষ পাকিস্তান
প্রতিপক্ষ(সমূহ) ভারত
মুক্তিবাহিনী
লড়াই ও যুদ্ধ (সমূহ) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
প্রতিষ্ঠা
সাংবাদিক ও গবেষক আজাদুর রহমান চন্দন তার এক বইয়ে লিখেছেন, একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘকে আল-বদর বাহিনীতে রূপান্তর করা হয়েছিল। এ বাহিনীর প্রতিষ্ঠা হয় ২২ এপ্রিল জামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর পদার্পণের পরপর ময়মনসিংহ জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মুহম্মদ আশরাফ হোসাইনের নেতৃত্বে। অন্যদিকে আল-শামস বাহিনীতে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাড়াও মুসলিম লীগপন্থী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও মাদ্রাসা ছাত্রদের সংগঠন জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার নেতা-কর্মীরা ছিল। আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর কর্মকাণ্ড ছিল অনেকটা একই রকম। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে এদের ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। [২] ১৯৭১ সালে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে আজাদুর রহমান চন্দন লিখেছেন, সে বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম ভাগ পর্যন্ত জামালপুরে আলবদর বাহিনী সাতটিরও বেশি ক্যাম্প স্থাপন করে। [৩]
২২ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে ময়মনসিংহ জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মুহম্মদ আশরাফ হোসাইনের নেতৃত্বে জামালপুর শহরে আল বদর বাহিনী গঠিত হয়।
দৈনিক পাকিস্তান ও পূর্বদেশ পত্রিকায় ২৩ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত সংবাদে আল বদর বাহিনী নিজেদের সম্পর্কে বলে,
"আলবদর একটি নাম! একটি বিস্ময়। আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী আলবদর সেখানেই! যেখানেই দোষ্কৃতকারী, আলবদর সেখানেই। ভারতীয় চর বা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।"
দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত সংবাদে ইসলামি ছাত্রসংঘের নেতা মতিউর রহমান নিজামী বলে,
"আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাকসেনাদের এ দেশের ইসলাম প্রিয় তরুন ছাত্র সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আল-বদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৩। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে ৩১৩ জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"
ইরানি বংশোদ্ভূত গবেষক সাইয়েদ ওয়ালি রেজা নাসের তার 'দ্য ভ্যানগার্ড অব দি ইসলামিক রিভলিউশন : দ্য জামায়াতে ইসলামী অব পাকিস্তান' শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, 'একাত্তরে সরকারের অণুপ্রেরণায় ইসলামী ছাত্রসংঘ (আইজেটি) হয়ে ওঠে জামায়াতে ইসলামীর মূল শক্তি। আর্মির সহায়তায় এরা আলবদর ও আলশামস নামে দুটি প্যারামিলিটারি ইউনিট গঠন করে বাঙালি গেরিলাদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য। ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার নাজিম-ই আলা (প্রধান) মতিউর রহমান নিজামী আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করেন।'[৪][৫]
তালিকা
মতিউর রহমান নিজামী : যুদ্ধাপরাধের দায়ে ১১ মে ২০১৬ সালে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে।
মীর কাসেম আলী : যুদ্ধাপরাধের দায়ে ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে।
আশরাফুজ্জামান খান
চৌধুরী মুঈনুদ্দীন
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ
আল শামস
আলশামস বাহিনী
অংশগ্রহণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
সক্রিয় ১৯৭১
মতবাদ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ,
পাকিস্তানের অখন্ডতা,
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা
নেতৃবৃন্দ ফজলুল কাদের চৌধুরী,
সাকা চৌধুরী
অপারেশনের এলাকা বাংলাদেশ
মিত্রপক্ষ পাকিস্তান
প্রতিপক্ষ(সমূহ) মুক্তিবাহিনী
লড়াই ও যুদ্ধ (সমূহ) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
আল শামস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গঠিত নিন্দিত আধা সামরিক মিলিশিয়া বাহিনী।[১]
নামকরণ ও প্রেরণা
আরবি শব্দ আল শামসের অর্থ দাঁড়ায় ‘সূর্য’। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আল শামস ও আল বদর বাহিনী গঠন করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী মুক্তি বাহিনীকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে।
প্রতিষ্ঠা
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামীর প্রচারযন্ত্র দৈনিক সংগ্রাম এর মাধ্যমে ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ ও যুদ্ধের ডাক দিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করে সে বাহিনীর আমীরের পদ গ্রহণ করলে তৎকালীন ছাত্রসংঘের কর্ণধার, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে আল শামস ও আল বদর বাহিনী গঠন করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের আমীর ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী আল বদর ও আল শামস বাহিনীর আমীরের পদ গ্রহণ করেন এবং সারা বাংলাদেশে প্রচারণা, সামরিক বাহিনীসমূহের সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা নগর ছাত্রসংঘের আমীর ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদও এসব বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। আবদুল কাদের মোল্লা সামরিক জিজ্ঞাসাবাদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আঙুল কাটার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় বেসামরিক লোকজনের উপর পরিচালিত অপারেশন সার্চলাইট এর পর বন্দি নেতৃত্ব তৎক্ষণাৎ পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়।
বিলুপ্তি
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাহিনীগুলো বিলুপ্ত হয়। এমনকি ১৯৭২ সালের পুরো জানুয়ারি মাসও ঢাকার কোথাও কোথাও তাদের দখল বজায় থাকে এবং বুদ্ধিজীবীরা নিহত হন।
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪.৩১ মিনিটে ঢাকার রমনা রেস কোর্স ময়দানে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী সই করেন।
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল তিন প্রস্থে প্রস্তুত করা হয়েছিল। একটি প্রস্থ ভারত সরকার এবং দ্বিতীয় প্রস্থ পাকিস্তান সরকারের নিকট সংরক্ষিত আছে ও তৃতীয় প্রস্থ ঢাকার শাহবাগ জাদুঘরে আছে।
যে টেবিলে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল তা ঢাকা ক্লাব থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই টেবিলটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৩৭ সংখ্যক প্রদর্শনী কক্ষে সংরক্ষিত আছে।
আত্মসমর্পণের দলিলের নাম ছিল "INSTRUMENT OF SURRENDER"। এই ঘটনাকে ফল অব ঢাকা বা ঢাকার পতন বলেও ডাকা হয়।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসিত ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অংশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করে। অতঃপর জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা ঘটে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে উপায়ন্তর না দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে তারা ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এতে ভারতের প্রধান মন্ত্রী বলেন যে “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে: (১) পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালী অভিমুখে; (২) উত্তরাঞ্চল থেকে দু’ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে; (৩) পশ্চিমাঞ্চল থেকে দু’ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ২য় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে; এবং (৪) মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষা কম আর একটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে।
যৌথবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সারা দেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করে। একের পর এক পাকিস্তানি ঘাঁটির পতন হতে থাকে। পাকিস্তানিরা অল্প কিছু জায়গায় তাদের সামরিক শক্তি জড় করেছিল; যৌথবাহিনী তাদের এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশের আপামর জনতাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ইতোমধ্যে পর্যদুস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩,০০০ সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। স্বাক্ষরিত হয় আত্মসমর্পণের দলিল। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়; প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙ্গালী জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান[সম্পাদনা]
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, ভারতীয় ও বাংলাদেশী বাহিনীর যুগ্ম কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ সেনাপ্রধান, এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার আত্মসমর্পণে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।[১]
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানি নৌ-পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার রিয়ার-অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শরিফ এবং পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বিমান বাহিনীর কমান্ডার এয়ার ভাইস-মার্শাল প্যাট্রিক ডেসমন্ড কালাঘান, যারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার আত্মসমর্পণের সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। ভারতের পক্ষে, ভারতীয় ৪র্থ কোরের কমান্ডার লেঃ জেনারেল সগত সিং, পূর্বাঞ্চলীয় বিমান বাহিনীর কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চাঁদ দেওয়ান, ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।
আত্মসমর্পণ দলিলের ভাষ্য[সম্পাদনা]
আত্মসমর্পণ দলিলের লেখা এখন বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারত সরকারের পাবলিক সম্পত্তি এবং এটি দিল্লি জাতীয় যাদুঘর প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে (জানুয়ারি ২০১২ হিসাবে)। দলিলের লেখা ইংরেজিতে ছিল এবং তা হল:[২]
The PAKISTAN Eastern Command agree to surrender all PAKISTAN Armed Forces in BANGLA DESH to Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA, General Officer Commanding in Chief of Indian and BANGLA DESH forces in the Eastern Theater. This surrender includes all PAKISTAN land, air and naval forces as also all para-military forces and civil armed forces. These forces will lay down their arms and surrender at the places where they are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA.
The PAKISTAN Eastern Command shall come under the orders of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA as soon as the instrument has been signed. Disobedience of orders will be regarded as a breach of the surrender terms and will be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA will be final, should any doubt arise as to the meaning of interpretation of the surrender terms.
Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA gives a solemn assurance that personnel who surrender shall be treated with dignity and respect that soldiers are entitled to in accordance with provisions of the GENEVA Convention and guarantees the safety and well-being of all PAKISTAN military and para-military forces who surrender. Protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorities and personnel of WEST PAKISTANI origin by the forces under the command of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA.
|
<signed> |
<signed> |
(JAGJIT SINGH AURORA)
Lieutenant-General
General Officer Commanding in Chief
India and BANGLA DESH Forces in the
Eastern Theatre
16 December 1971
|
(AMIR ABDULLAH KHAN NIAZI)
Lieutenant-General
Martial Law Administrator Zone B and
Commander Eastern Command
(Pakistan)
16 December 1971
|
- অনুবাদ[৩]
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।
এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে।
|
<স্বাক্ষর করেন> |
<স্বাক্ষর করেন> |
(জগজিৎ সিং অরোরা )
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল
জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও বাংলা দেশ যৌথ বাহিনী
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
|
(আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি)
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল
সামরিক আইন প্রশাসক অঞ্চল বি
অধিনায়ক পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড (পাকিস্তান)
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
|
|